পহেলা বৈশাখ, নববর্ষ ও ইসলাম

Tags

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ। অথচ বর্তমানে অস্বীকৃতি, অস্পষ্টতা ও অসংলগ্নতার ঘূর্ণাবর্তে পহেলা বৈশাখ হয়ে যাচ্ছে একপক্ষীয়।

তাই আনুষ্ঠানিক বর্ষবরণে কারো অংশগ্রহণ বা কারো বিরত থাকার মধ্যে বিভক্তি রেখা আবিষ্কার কাম্য নয়। জাতিগতভাবে বিষয়টি বাধ্যতামূলক বা নিষিদ্ধকরণের পরিবর্তে এটিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বীকৃতি দেওয়াই যৌক্তিক। কেননা সংস্কৃতি কখনোই আরোপিত বিষয় নয়, বরং মানুষের সুকোমল প্রবৃত্তির বহুল চর্চা ও অনুশীলনের স্বাভাবিক প্রকাশ হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতির বিকাশ একটি নিরপেক্ষ কালোত্তীর্ণ-মানোত্তীর্ণ ধারণা ও সময়সাপেক্ষ অর্জন।
নববর্ষ, হোক তা বঙ্গাব্দ বা ইংরেজি বর্ষবরণ। নববর্ষ ঘিরে থাকে বিশেষ ব্যবস্থা। নিরাপত্তা চাদরে ঢেকে দেওয়া হয় সারা দেশ। ভুবুজেলা ও মুখোশ ব্যবহার, মোটরসাইকেলে একাধিক আরোহী, সব ধরনের ব্যাগ বহন, বিকেল ৫টার পর উন্মুক্ত স্থানে সমাবেশসহ অনেক কিছুই থাকে নিষিদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখতে থাকে বিশেষ সতর্কতা ও সিসি ক্যামেরার নজরদারি। তার পরও বৈশাখী উৎসবে থাকে প্রাণের ছোঁয়া, থাকে উচ্ছ্বাসের বাঁধভাঙা জোয়ার।
সংস্কৃত প্রবাদে আছে ‘আনন্দে নিয়ম নাস্তি’। তবে বৈশাখী উৎসবে যা যা করা হয়, তা নিয়ে ধর্মীয় ব্যাখ্যার অবকাশ প্রসঙ্গে কেউ বলেন, উৎসবের সঙ্গে ধর্মের সংশ্লেষ নেই। কেউ বলেন, এটা স্রেফ বাঙালির সর্বজনীন চেতনা। অথচ নিরেট সত্য কথা হচ্ছে যে আমরা একই সঙ্গে বাঙালি ও মুসলমান। বাঙালিত্ব ও ঈমানি বিষয়ে দ্বন্দ্ব নেই বলেই তো ধমকের যেমন প্রয়োজন নেই, তেমনি আপসেরও দরকার হয় না। কেননা, ধর্মীয় চেতনা কখনোই এক দিনের বিশেষ বিষয় নয়। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গে শৈথিল্যের অবকাশ রাখা হয়নি, এক দিনের জন্যও নয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে যেসব উৎসব-আয়োজন ও খেলাধুলার মাধ্যমে মানুষের জীবন-সম্ভ্রমের নিরাপত্তাঝুঁকি, নামাজ-ইবাদতের জন্য প্রতিবন্ধক, বিধর্মীদের অনুসরণ, সময় ও অর্থের অপচয়, জুয়া-লটারি, রং খেলা, উদ্দামনৃত্য-গীত, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, উল্কি আঁকা, অবৈধপণ্যের বিপণন ইত্যাদির বাহুল্য থাকে, তা একজন ঈমানদারের জন্য অশোভন। কেননা শরীর ও মনের বিকাশে যেসব কাজকর্মের ফলে ফরজ লঙ্ঘন অথবা হারামের অনুষঙ্গ তৈরি হয়, সে সব কিছুই ইসলামের দৃষ্টিতে কবিরা গুনাহ। একটি কবিরা গুনাহ জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার যৌক্তিকতা হিসেবে যথেষ্ট। কবিরা গুনাহ তাওবা ছাড়া মাফ হয় না।
সুস্থ সংস্কৃতি হলো মানব মননের সুকোমল অভিব্যক্তি, যা ভূগোল ও বিশ্বাসের সীমা ছাড়িয়ে পরিশীলিত ঐক্য ও বিবেকের জাগরণ ঘটায়। অথচ প্রিয়নবী (সা.)-এর নবুয়ত-পূর্ব জাহেলিয়াত বা ‘মূর্খতার যুগে’ উৎসব, আনন্দ-বিনোদনের মধ্যে ছিল না মানবতা-নৈতিকতার ছোঁয়া। উৎসবের বেলেল্লাপনার শিকার হয়ে বিশিষ্ট ও বয়োজ্যেষ্ঠ একজন সাহাবি গুরুতর আহত হওয়ার পটভূমিতেই সুরা মায়েদার ৯০ নম্বর আয়াত নাজিল হয়। এ আয়াতের মাধ্যমে মদ, মূর্তি, জুয়া, লটারিকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণার পাশাপাশি একে ‘ঘৃণিত শয়তানের কাজ’ বলা হয়েছে।
জাহেলিয়াত বা ‘মূর্খতার যুগে’ আরবরা যুদ্ধবিদ্যা, অতিথি সেবা, পশুপালন, দেশভ্রমণ, আন্তর্দেশীয় ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদিতে ছিল বিখ্যাত। শিল্প-সাহিত্যেও তারা কম যায়নি। ইতিহাসখ্যাত ছিল সে সময়ের ‘উকাজের মেলা’। কবিতা উৎসবের সর্বশ্রেষ্ট সাতটি কবিতা স্থান পেয়ে ছিল পবিত্র কাবার দেয়ালে। যাকে বলা হয় ‘সাবউল মুয়াল্লাকাত’। ইরানে ছিল নববর্ষ পালন ও ঘৌড়দৌড় উপলক্ষে প্রচলিত দুটি উৎসব ‘নওরোজ’ ও ‘মেহেরজান’। অথচ এত সব কিছুর কোথাও ছিল না সুস্থ বিবেকবোধের চর্চা; বরং সংস্কৃতির নামে ছিল অপসংস্কৃতির অবাধ্যতা। খাদ্যের সঙ্গে মিশে থাকা চুল, কাঁকড়জাতীয় বস্তু যেমন অখাদ্য, তেমনি সংস্কৃতির মধ্যে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশই বা কতটা যৌক্তিক, তা ভেবে দেখা জরুরি।
প্রাণ ও প্রকৃতির সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। আমরা ভাগ্যবান, আমাদের বর্ষপঞ্জি আছে, ইংরেজদের নেই। তারা ব্যবহার করে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। ‘সন’ ও ‘তারিখ’ আরবি শব্দ। ‘সাল’ ফারসি শব্দ। এগুলো স্মরণ করিয়ে দেয় বাংলা সনের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পৃক্ততার কথা। বর্ষ পরিক্রমা প্রসঙ্গে আল কোরআনের বাণী : ‘তিনি সূর্যকে প্রচণ্ড দীপ্তি দিয়ে/চাঁদ বানিয়ে দিলেন স্নিগ্ধতা ভরে/বছর গণনা ও হিসাবের তরে। ’ (কাব্যানুবাদ, ইউনুস : ০৫)
পবিত্র কোরআনে ১২ মাসে এক বছর প্রসঙ্গে আছে ‘নভোমণ্ডল-ভূমণ্ডল সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই আল্লাহ ১২টি মাস নির্ধারণ করেছেন...। ’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ৩৬)।
আয়াতটি নাজিলের পটভূমিতে জানা যায়, জানাদা ইবনে আউফ (রা.) প্রকৃতির স্বাভাবিক রীতিতে বিঘ্ন ঘটিয়ে বছরের শুরুতে ঘোষণা করত—‘এ বছর ১৩ মাসে’, ‘ওই বছর ১৪ মাসে’ বা ‘১১ মাসে’ ইত্যাদি। উদ্দেশ্য, যুদ্ধবিরতি পালনে বিঘোষিত ‘সম্মানিত মাস চারটি’কে এড়িয়ে যাওয়া।
আমাদের দেশেও ‘আঠারো মাসে বছর’—এমন কথা প্রচলিত আছে। কথিত আছে ‘শের-ই-মৈশুর’খ্যাত টিপু সুলতান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় সৈন্যদের বেতন দিতেন ৩৫ দিনে মাস হিসাব করে।
মানুষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা স্মরণ করে সময়-তারিখ বলে, যেমন সংগ্রামের বছর, বন্যার বছর, আকালের বছর, আবিসিনিয়ায় আবরাহার হস্তিবাহিনী ধ্বংস হওয়ার ফলে চালু হয় ‘হস্তিবর্ষ’। ইতিহাসে দেখা যায়, বিশেষ ঘটনাকেন্দ্রিক সন ব্যবস্থার প্রচলন। যেমন—হজরত ঈসা (আ.) স্মরণে খ্রিস্টাব্দ বা ঈসায়ী সন। প্রিয়নবী (সা.)-এর হিজরতের বছর ৬২২ খ্রিস্টাব্দকে প্রথম বছর ধরে ঘটনার ১৭ বছর পর হজরত ওমর (রা.) হিজরি সন প্রবর্তন করেন।
১২০৪ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি বাংলা বিজয়ের ফলে হিজরি সন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায়। তবে চান্দ্র ও সৌরবর্ষের গণনা রীতিতে পার্থক্যে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। পৃথিবী নিজ কক্ষপথে ঘুরতে সময় লাগে প্রায় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড। আবার চন্দ্রকলার হ্রাস-বৃদ্ধিতে সময় লাগে প্রায় ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা। যে কারণে এক চান্দ্র বছর হতে সময় লাগে প্রায় ৩৫৪ দিন ৮ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট। চান্দ্র মাসভিত্তিক বছরে ১০ থেকে ১১ দিনের তারতম্যে প্রতিবছর সন-তারিখের হিসাব মেলাতে সমস্যা হয়। তখন রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি সনের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে সম্রাট আকবরের সভাসদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি একটি নতুন সৌরসন উদ্ভাবন করেন। তিনি হিজরির ৩৫৪ দিনের পরিবর্তে ৩৬৫ দিন ধরে যে নতুন সন উদ্ভাবন করেন, তা-ই ‘বাংলা সন’। সম্রাট আকবর ফরমান জারির মাধ্যমে এই নতুন সন গণনা করেন, যার সূচনা ধরা হয় তাঁরই মসনদে আরোহণের বছর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ, ৯৯২ মতান্তরে ৯৯৩ হিজরিকে। আকবরের ‘ফসলি সন’ যখন চালু হয়, তখন সুবে বাংলায় মহররম ছিল বৈশাখ মাস। সে জন্যই নতুন সনের প্রথম মাস হয়ে যায় বৈশাখ। ১৯৫৪ খ্রি. ‘যুক্তফ্রন্ট’ সরকার গঠিত হলে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন।
ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণে সন-তারিখের প্রচলন মুসলিম শাসকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মহীশুরের শাসক টিপু সুলতান প্রিয়নবী (সা.)-এর নবুয়ত লাভের বর্ষকে সূচনায় এনে বিশেষ রীতিতে ‘মুহাম্মদী সন’ প্রবর্তন করেন। আকবরের ‘ফসলি সন’ গণনা রীতিতে চট্টগ্রাম ও আরাকানে প্রচলিত হয় ‘মগি সন’। পার্বত্য জনপদে ‘বৈসাবি’ নামে বর্ষবরণের রীতি প্রচলিত। পার্বত্য তিনটি উৎসবের আদ্যাক্ষর দিয়ে গঠিত শব্দ ‘বৈসাবি’। ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুক, বৈসু বা বাইসু ও মারমাদের কাছে সাংগ্রাই, অন্যদিকে চাকমা ও তঞ্চঙ্গাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত উৎসব হলো বাংলা নববর্ষ বা ‘বৈসাবি’। হিজরি সনের আদলে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত হয়েছিল ‘বিলায়তি সন’, ‘আসলি সন’, ‘ইলাহি সন’ ও ‘জালালি সন’ ইত্যাদি। এসব সন গণনারীতির সঙ্গে প্রিয়নবী (সা.)-এর স্মৃতি ও ইসলাম-মুসলিম ঐতিহ্যের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত স্পস্ট।
আমরা মুসলমান। মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। ইসলামী সংস্কৃতি মহান আল্লাহর আদেশ ও প্রিয়নবী (সা.)-এর আদর্শিক চেতনায় উজ্জীবিত এবং ইহ ও পারলৌকিক শান্তি-মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত। অন্যদিকে বৈশাখী উৎসব নিছক এক দিনের সস্তা বিনোদনের বিষয় নয়, বৈশাখী উৎসব আমাদের জাতীয় পরিচিতি সংরক্ষণের ডাক দেয়। বাংলা নববর্ষের ক্রমবিবর্তনে রয়েছে মুসলিম ঐতিহ্য ও পুরনোকে মুছে ফেলে নতুন শপথে পথ চলার অঙ্গীকার। মুসলিম লোকভাবনাসমৃদ্ধ ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’য় নববর্ষের আবাহন ধ্বনিত হয়েছে—‘আইল নতুন বছর লইয়া নব সাজ,/কুঞ্জে ডাকে কোকিল-কেকা বনে গন্ধরাজ। ’
অথবা ‘বৈশাখ মাসেতে গাছে আমের কড়ি/পুষ্প ফুটে পুষ্প ডালে ভ্রমর গুঞ্জরি। ’ (কমলা পালা)
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর


EmoticonEmoticon