ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রথম ৩০ সেকেন্ডে নজর কাড়ুন, নইলে পরেরটির প্রস্তুতি নিন

আমরা দুই ধনরেন মানুষকে মনে রাখি, প্রথমত যারা সুখ্যাতিতে বিখ্যাত অথবা যারা কুখ্যাত। বিখ্যাত এবং কুখ্যাত এর মাঝের লোকের সংখ্যাই বেশি এবং এদের কেউ মনে রাখে না। একটা জব ইন্টরভিউতেও ঠিক যেসব প্রার্থীরা আসে তাদের মধ্যে সব থেকে ভাল যারা করে তাদের নিয়ে ভাবা হয়, সব থেকে খারাপ যারা করে তাদের নিয়েও কিছু আলোচনা হয়, বিশ্বাস করুন গড়ের যারা তাদের নিয়ে ভাবার সময় কারো থাকে না। এই আর্টিকেলে আমি নিজের চাকুরীর ইন্টারভিউ দিতে যাবার অভিজ্ঞতা, দীর্ঘদিন নিজে ইন্টারভিউ নেয়ার অভিজ্ঞতা এবং ইন্টারনেটের বিভিন্ন আর্টিকেল সংমিশ্রন করে ইন্টারভিউ বোর্ডে কেন কাউকে সিলেক্ট করে সেসব বিষয়ে ধারনা দেয়ার চেষ্টা করব। অভিজ্ঞতা ব্যাপারটি যেমন ভিন্ন তেমনি এই লেখার সাথে কারো দ্বিমত থাকতে পারে, বা এটাকে আমি একমাত্র উপায় বলছি না, হতে পারে এর বাইরেও ধারনা আছে।

ইন্টারভিউ সংক্রান্ত ভয়ঃ
যে কেউ যে কাউকে ইন্টরভিউ বোর্ড কিভাবে ফেস করতে হবে তার উপদেশ পরামর্শ দিতে পারবে, তাতে সে যদি নিজে জীবনে কোন ইন্টারভিউতে সফল হতে নাও পারে। জ্ঞান পরামর্শ বিলি করাটা যতটা কঠিন তার থেকে বাস্তবে করাটা কঠিন। প্রথমত নার্ভাসনেস আপনাকে গ্রাস করবে, আপনি ছাড়া যাকে দেখবেন তাকেউ মনে হবে আপনার থেকে মনে হয় বেশি যোগ্য। আমি ২০০৯ সালে জীবনে প্রথম জবের ইন্টারভিউ দেই, নিজের প্রতিষ্ঠান খুলনা শহরে রেখে ঢাকায় যখন পড়তে যাই তখন মনে হল টুকটাক আয় করলে খরচটা চালানো সহজ হবে। প্রথম পড়লাম চিটিংবাজদের খপ্পরে যারা জবের কথা বলে আগে ট্রেনিং দেবে বলে টাকা দাবী করে বসল। সেই ইন্টারভিউ বোর্ডে ইংরেজিতে দুয়েকলাইন বলতে গিয়ে ঘেমেটেমে একাকার, এরপর জবের দুটি ইন্টারভিউ দেই যা কেবল তাদের নিয়োগ পদ্ধতি কেমন সেটা বুঝতে, তো এ ব্যাপারে জব পাওয়া না পাওয়া সংক্রান্ত কোন টেনশন ছিল না, ছিল ঘটনা কি সেটা দেখার। তো বিনা মানসিক চাপে ‍দুটিই বেশ ভাল হয়েছিল, সর্বশেষ একটিতে ৬ ডিজিটের বেতন অফার পেয়েছিলাম। মোটামুটি এতটুকু বুঝলাম যে অনেক ভাল ক্যান্ডিটেড কেবল নার্ভাসনেস থাকার জন্য গুলিয়ে ফেলে প্রথম ৩০ সেকেন্ড নিজেকে পজেটিভলি প্রেজেন্ট করতে পারেন না এবং খারাপ করেন। দেখুন একটি জব না হলে আপনি মারা যাবেন না বা যিনি ইন্টারভিউ নেবেন তার হাতে পিস্তল নেই যে ভুল করলে ‍গুলি করবে। ইন্টারভিউ আপনার জন্য পুলসিরাত না যে এটাই শেষ খেলা, আর সুযোগ নেই। ভয় কাটাতে পারলে ইন্টরভিউ বোর্ডে রক এন রোল করার প্রথম ধাপ পার করে ফেল্লেন।

সফল ক্যারিয়ার ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যারিয়ার টিপস

বার বার রিজেক্টেড চরম হতাশাঃ
আপনি যদি বার বার ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে বাদ পড়েন ধরে নিতে হবে আপনি গড়ের লেভেলে আছেন, চমক দেখাতে পারছেন না। আমাদের মাঝে অনেকে আছেন যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ভাল, ভাল বিশ্ববিদ্যালয়, ভাল রেজাল্ট, জবে যা চাওয়া হয়েছে সব আছে। ভাল সিভি বলেই শর্টলিষ্টে থাকনে, এরপর বোর্ডে বাদ পড়ে যান। এই আর্টিকেল লেখার দিন কলেজে একজন CSE বিভাগের লেকচারার নিয়োগের ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম, সেখানে ১টি পদের বিপরীতে যে ৫ জনকে শর্টলিষ্ট করা হয়েছিল তারা সবাই সিভির দিক থেকে সমান কিন্তু ইন্টারভিউ বোর্ডে আকাশ-পাতাল ব্যাবধান হল। প্রথমত, যারা প্রথম কিছু সময়ে নজর কাড়তে পারেন না তাদের কমিউনিকেশন স্কিল বিশেষ করা কথা বলার দক্ষতা ব্যাপক ঘাটতি, আর যারা ভাল করেন তাদের কমিউনিকেশন স্কিল উন্নত। অনেক প্রার্থী পেয়েছি যারা বিষয়ভিত্তিক নলেজ কম তবু কথাবার্তা দিয়ে ভালই চালিয়ে যান। সুতরাং এই একটি যোগ্যতা যদি আপনার চমৎকার থাকে তাহলে ইন্টারভিউবোর্ডে নিজেকে প্রথম ২০-৩০ সেকেন্ডর মধ্যে আপনি সবার নজরে আনতে পারবেন। একটা গবেষণা বলছে ৬৩% বস প্রথম ৯০ সেকেন্ড সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন কোন আপনাকে সিলেক্ট করা হবে কি না?! ‍সুতরাং আপনার হাতে বেশ কম সময় থাকে নিজেকে প্রমান করার জন্য। বিশ্বাস করুন আপনি ইন্টরনেট ঘাটলে লক্ষ লক্ষ কন্টেন্ট পাবেন কিভাবে ইন্টারভিউ বোর্ড ভাল করার যায় কিন্তু যদি আপনি কথা বলা ও কমিউনিকেট করতে না পারেন সেসব ‍গুলে খাওয়ালেও আপনি ভাল করতে পারবেন না। তো হতাশা থেকে বের হতে চাইলে নিজের কমিউনিকেশন (যোগাযোগ) দক্ষতা ডেভলপ করুন। বাস্তবতা হল এসব কিন্তু হুট করে ডেভলপ করা যায় না, পাবলিক স্পীকার বা মটিভেশনাল স্পীকারদে কথা শুনে একদিন বা ১ মাসে শেখার জিনিস না। এটা দীর্ঘ সময়ে একটা অভ্যাস ও চর্চার ফলে তৈরি হবে। যখন ছাত্র ছিলেন তখন যদি বিভিন্ন কো-কারিকুলার প্রোগ্রমে অংশগ্রহন করেন, মানুষের সাথে ইন্ট্যারাক্ট করার অভ্যেস থাকে তাহলে জিনিসটা সহজে হবে। যারা ছাত্র আছেন তারা নিজেদের একটা মোবাইল আর একটা ঘরে আবদ্ধ না রেখে মানুষের সাথে ইন্ট্যারাক্ট করার অভ্যেস করুন।

ভয় এবং হতাশা এই দুটি জিনস থেকে বের হয়ে কিছু প্রস্তুতিমূলক পরামর্শ দিলাম যা না করার ফলে আপনি জব ইন্টারভিউতে ভাল করতে পারছেন না। এগুলো করলে নিশ্চিত আপনি আগের থেকে ভাল পারফর্ম করবেনঃ

১. যে প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছেন তাদের সম্পর্কে একটু রিসার্চ করেন, তাদের খোজ খবর ইন্টারনেটে নিন, ওয়েবসাইট বা ফেসবুক/লিংকডইন পেজ ঘাটাঘাটি করুন। তাহলে ইন্টারভিউ দেয়ার সময় মনে হবে প্রতিষ্ঠানটি আপনার কাছে পরিচিত। দয়া করে চাকুরীর সার্কুলারে দেয়া জব ডেসক্রিপশন বা কি কি দায়ীত্ব পালন করতে হবে সেটা পড়ুন, বুঝুন যে সেই সংক্রন্ত কাজ নিয়ে প্রশ্ন করলে কিভাবে উত্তর দেবেন।

২. যুদ্ধের প্রস্তুতির নেয়ার সময় যেমন সৈনিক তার পোশাক অস্ত্র এসব সাজিয়ে নেয় আগেই। তেমনি আপনাকে কি পরিধান করে যাবেন, সিভি, একটা পেন, অন্যান্য পেপারস, এসব সাজিয়ে নিন। ধরুন আপনি বিরাট একটা ব্যাগ নিয়ে ঢুকে গেলেন বা লাল রঙের একটা ফাইল বা ২ টাকা দামের একটা স্বচ্ছ ফাইলে সিভি নিলেন এর কোনটি আপনার ইমপ্রেশন ভাল করবে না। আপনার বেষ্ট পোষাকটি পড়ুন (ফরমাল), গায়ে ঘামের গন্ধ আছে কি না খেয়াল রাখুন, অপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে না যাওয়ার চেষ্টা করুন। চুল দাড়ি, নিজের লুক ঠিক করে যাবেন, প্রয়োজনে ফেসিয়ালে করে যাবেন। হ্যা সত্যি, সবার মাঝে যদি নিজেকে পরিপাটি দেখাতে পারেন হতে পারে সেটাই আপনার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে।

৩. হাসিমুখ, আইকন্ট্যাক্ট ঠিক রাখুন। ধরুন মারাত্নক জ্যাম ঠেলে, বাসে হেল্পারের সাথে মারামারি করে ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন ১০ টায়, দুপুর হয়ে গেছে এরপরও কোম্পানীর বস আসে না, এরকম অবিবেচক লোকের খপ্পরে পড়লেন, মেজাজ বিগড়ে আছে, সেটা বোর্ডে যেন প্রকাশ না পায়। আপনাকে দেখে যেন মনে হয় বেশ খোশ মেজাজে আছেন। নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলা বা অন্য দিকে তাকালে কাজ হবে না। ইন্টারভিউয়ারের সাথে আইকন্ট্যাক্ট রাখুন। ইমোশন বোঝার চেষ্টা করতে হবে।

৪. ইন্টারভিউ বোর্ডে যারা আছে তাদের ১-২টা প্রশ্নে তাদের বোঝার চেষ্টা করুন। তাদের মোড কি কি চাচ্ছে সেসব। সম্ভব হলে কোম্পানীর যারা ইন্টারভিউ নেবে তাদের সম্পর্কে খোজ খবর নিয়ে যান, তাহলে তাদের মত প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করলে সম্ভাবনা ৮০% বেড়ে যাবে যা পরিক্ষীত।

৫. কৃত্তিমতা লুকাতে হবে, হ্যা অনেকসময় চাকুরী পাবার জন্য আপনার নিজের পছন্দ না হলেও একটা জবে আবেদন করেছেন। জিজ্ঞেস করেছে এই জবে কেন? তখন বানিয়ে কমন উত্তর দিচ্ছেন যা বস যারা তারা বোঝেন যে আপনি গরু রচনা পাঠ করছেন। এক্ষেত্রে নিজের মত উত্তর দিন, আপনি যে কৃত্তিম উত্তর দিচ্ছেন সেটা পরিহার করুন। না পারলে এমন কৌশলে বলুন যাতে নকল মনে না হয়।

৬. সালাম/অভিবাদন প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় প্রাকটিস করুন। সবসময় পজেটিভ এটিইচুুউড দেখানোর চেষ্টা করবেন, জবটি আপনি সত্যিই করতে আগ্রহী, আপনাকে নিলে প্রতিষ্ঠান লাভবান হবে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করবেন।

৭. অতিরিক্ত জ্ঞান জাহির করতে গেলে ধরা খাওয়ার চান্স থাকে, সেক্ষেত্র সংক্ষিপ্ত কিন্তু বেষ্ট উত্তর দেয়ার চেষ্টা করতে হবে।

৮. ইন্টারভিউ শেষে জব হোক বা না হোক ধন্যবাদ দেবেন যে আমাকে ডাকার জন্য ধন্যবাদ স্যার। প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে দুয়েকটা ভাল কথা বলে বিদায় নিন। আরো ভাল যদি যে মেইল করে একটা ধন্যবাদ দিলেন। এতে আপনার এবার না হলে পরে চান্স তৈরি হবে।

৯. মিথ্যা তথ্য ও অসততার আশ্রয় নেয়া থেকে দূরে থাকুন, কারো রেফারেন্স আছে সেসব ইন্টারভিউ বোর্ডে না বলে নিজের যোগ্যতায় জব পাওয়ার চেষ্টা করুন। ধরুন আপনি কারো রেফারেন্স থাকার জন্য ইন্টারভিউতে কল পেয়েছেন, কিন্তু ইন্টারভিউতে চেষ্টা করুন নিজেকে প্রমান করতে।

১০. নিজেকে প্রতিদিন একটু করে ডেভলপ করুন, বার বার একই রকম হলে বুঝতে হবে আপনার ঘাটতি আছে। শুধু কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স পড়ে ইন্টারভিউ বোর্ডে ভাল করা যায় না। জ্ঞানের সাথে সাথে পার্সোনাল স্কিলস জরুরী। বই পড়ুন, পত্রিকা পড়ুন, বিভিন্ন আর্টিকেল পড়ুন, কোথাও সুযোগ পেলে আলোচনায় অংশ নিন। Keep upgrading yourself.

আপাতত এই ১০টি জিনিস মাথায় রাখলে আশা করি ভাল পারফর্ম করতে পারবেন।

Source: linkedin by MD Badiuzzaman


EmoticonEmoticon